স্বাধীনতার ঘোষক, জাতির পিতা, জয় বাংলা এবং এর দাবীদার কে?
স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করা মেজর জিয়ার থেকে পাওয়া দলিলে এই প্রশ্নের উত্তর কেমন হয় তা জানার চেষ্টা
মুজিব, একটি জাতির রূপকার। যার নামের উপর ভরসা করে একদল তরুণ যুদ্ধে নেমে যায় বিশাল শক্তিশালী সেই সময়ের এক আর্মি পরাশক্তির বিরোদ্ধে। সেবার জয় লাভের পরেও অনেক বার সেই জয়কে নানা ভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার সুযোগ তো থেমে নেই। মীমাংসিত বিষয়ে প্রতিনিয়ত নানা কন্সপারাইসির জন্ম দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ, আমাদের স্বাধীনতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হচ্ছে।
এই চক্রের বেশ কিছু বিষয় আছে যা নিয়ে তারা রেগুলার যুদ্ধে নামার চেষ্টা করে।
১। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক না।
২। মুজিব স্বাধীনতা চায় নি।
নতুন করে আসলো
১। জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান না।
৩। মুজিব দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক না এবং জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান না।
জয় বাংলা মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান না এটা ২০২৪ সালে এসেছে। নানা ভাবে নানা জন বলে যাচ্ছে "ইতিহাস বলে জন্মগতভাবেই আমাদের স্লোগান বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।" তো এই বাংলাদেশ জিন্দাবাদ আসলে কাড় স্লোগান? ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের যত দলিল আছে তার কোন দলিলেই আমি "বাংলাদেশ জিন্দাবাদ" বলে কিছু পাইনি। মুক্তিযুদ্ধের যত দলিল এমনকি জিয়ার ভাষণেও জয় বাংলার ব্যবহারই পেয়েছি কেবল। তার মানে দাঁড়ায় যে " জয় বাংলা" স্লোগানের উপরই এই জাতির জন্ম হয়েছে।
প্রমাণ হিসেবে মেজর খালের মোশাররফের এই ক্লিপটি বেশ ভালো একটা এভিডেন্স। তিনি মুক্তিযুদ্ধাদের শপথ পাঠ করাবার সময় স্পষ্ট মুজিবের নাম ও জয় বাংলা উচ্চারণ করেছে। "জয় বাংলা, তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব। জয় বাংলা, জয় বাংলা" ।
মুক্তিযুদ্ধের নেতা কে ছিলেন এবং জয় বাংলা কোন দলের ব্যক্তিগত স্লোগান কিনা সেটার প্রশ্নের উত্তর এখানে অনেকটা স্পষ্ট। এর পরে যে প্রশ্ন থাকে স্বাধীনতার ঘোষণা কে দিয়েছিলো তাকে নিয়ে।
২৭ মার্চে জিয়া যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিলও তখন তিনি বলে
"I, Major Ziaur Rahman, on behalf of our great national leader, the supreme commander of Bangladesh Sheikh Mujibur Rahman, do hereby proclaim the independence of Bangladesh.
It is further proclaimed that Sheikh Mujibur Rahman is the so of the elected representatives of 75 million people of Bangiquean. I therefore appeal on behalf of our great leader, Sheikh Mujibur Rahman, to the government of all the democratic countries of the world especially the big world powers and the neighboring countries, and to take effective steps to stop immediately the awful genocide that is being carried on by the army of occupation from Pakistan to dub us the legally elected representatives of the majority of the people. As a sessionist, it is a cruel joke and contradiction in terms which should befool none. The guiding principle of a new step will be first, neutrality, second, peace, and third, friendship to all and enmity to none. May Allah help us. Joy Bangla."
যেখানে জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নাম নিয়েছে টানা ৩ বার, ঘোষণা শেষে জয় বাংলা বলে স্বাধীনতার ঘোষণা সবাইকে জানালো সেখানে মুজিব এবং জয় বাংলা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে সেটা ইতিহাসের সাক্ষীর কাছে এসে টিকে না।
মুজিব স্বাধীনতা চায় নি? নাকি রক্তপাত? কোনটা?
মুজিব স্বাধীনতা চায় নি? নাকি রক্তপাত? কোনটা? এর উত্তরও জিয়াই দিয়ে গিয়েছন। মেজর জিয়া তার লেখা বই একটি জাতির জন্ম ও অন্যান্য তে ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়ে লিখেছেন "৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনো হলো।"
তিনি আরো লিখেন "১৯৬৩ সালে আমি ছিলাম সামরিক গোয়েন্দা বিভাগে। সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের তদানিন্তন পরিচালক মেজর জেনারেল নওয়াজেশ আলী মালিক এক সময় আমার এলাকা পরিদর্শন করেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল একদিন। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কিছুটা উন্নতর করবার সরকারি অভীপ্সা সম্পর্কে দ্বিমত পোষণ করছিলেন তিনি। এক পর্যায়ে এ ব্যাপারে তিনি আমার অভিমত জানতে চাইলে আমি বললাম, বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যদি ব্যাপক অগ্রগতি সাধন করা না হয়, তাহলে দেশে প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখা সরকারের পক্ষে কঠিন হবে। এর জবাবে তিনি বললেন, বাংলাদেশ যদি স্বয়ম্ভর হয় তাহলে সে আলাদা হয়ে যাবে। পাকিস্তানের শীর্ষ স্থানীয় সামরিক কর্তাদের বাংলাদেশ সম্পর্কে এটাই ছিল মনোভাব। অথচ তারাই তখন দেশটা শাসন করছিলেন। তারা চাচ্ছিলেন বাংলাদেশটাকে অর্থনৈতিক দিকে দিয়ে দেউলিয়া করে রাখতে।"
আর এই আওয়ামীলীগের ৭০ এর নির্বাচনে বিজয় ছিলো পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের মাতব্বরি বন্ধ করা। আর মুজিব ক্ষমতায় গেলে পূর্ব পাকিস্তানে শ্বায়তব্ব শাসন নিয়ে আসবে এটা ছিলো নিশ্চিত, কারণ ১৯৬৬ সাল থেকেই মুজিব এই নিয়ে আলাপ করে যাচ্ছিলো। আর এটা হয়ে গেলে রক্তপাত ছাড়াই দেশ স্বাধীন হতে পারতো।
জিয়া সেই বইতে আরো লিখেছেন "আখ্যায়িত করতো আমাদের আওয়ামী লীগের দালাল বলে। একাডেমীর ক্লাসগুলোতেও সব সময় বোঝানো হতো, আওয়ামী লীগ হচ্ছে ভারতের দালাল। পাকিস্তানের সংহতি বিনষ্ট করতেই আওয়ামী লীগ সচেষ্ট। এমন কি উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবেই ক্যাডেটদের শেখানো হতো, আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হচ্ছেন ওদের রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় শত্র।"
এই লাইনে পূর্বের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে জিয়াও মুজিবকে জাতির পিতা বলেই সম্ভোধন করে। বিএনপিতে জামাতের প্রভাবে যারা মুজিবকে জাতির পিতা মানা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে তাড়া কার্যত তাদের দলের জন্মদাতা মেজর জিয়াকেই ছোট করে বলে আমার মনে হয়।
মুজিব দেশের সার্বভৌমত্ব নষ্ট করেছে
হ্যাঁ, এই কথাও এখন আমাদের দেশেই মানুষ বলছে। শুনে মনে হতে পারে এটা পাকিস্তানের প্রাইমারির কোন বইতে আছে, কিন্ত না "দেশের অস্তিত্ব-সার্বভৌমত্ব নষ্ট করেছে শেখ মুজিব" এই কথা বলেছে সারজিস। পাকিস্তানের দৃষ্টিতে দেখলে এটা অবশ্য সঠিক যে মুজিব পাকিস্তান ভেঙ্গে দিয়েছে। এর বাইরে কিছু না।
ইতিহাসের পাতায় কিছুক্ষণ হাতলেই মুজিব, জয় বাংলা, স্বাধীনতা, জাতির পিতা ইত্যাদি নিয়ে জামাতি এবং পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডা পায়ের বাতাসে উরে যায়। বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের উচিৎ নিজেদের এই বিবেধ ভুলে সামনে আগানো। যার যতটা অবদান তাকে সেটা দিলে কেউ ছোট হয় না, জিয়াকে ছোট করলে মুজিব বড় হয়ে যায় না, মুজিবকে ছোট করলে জিয়া বড় হয়ে যায় না। দুই দলের এই বড় ছোট খেলায় সবচেয়ে বড় লাভবান হয় স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি জামাত ও পাকিস্তান। অথচ মুক্তিযুদ্ধা, জিয়া, মুজিব কোন এক দলের সম্পদ না। তাদের হাত ধরেই দুই দলের জন্ম তবে দুই দলেরই উচিৎ নিজদের দলের বাইরেও যেন মানুষ ধারণ করতে পারে সেই পথ তৈরি করা। মুজিবকে নিয়ে জিয়া কখনো বাজে মন্তব্য করছে এমন প্রমাণ একটাও পাইনি, মুজিবও জিয়াকে নিয়ে এমন কিছু করেনি। যে সমস্যা কখনো ছিলো না জামাতের ইনফ্লুয়েন্সে এসব সমস্যা তৈরি দিন দেশে দেশের ইতিহাস, গর্ব, এবং ভবিষ্যৎ সব কিছুর জন্যই ক্ষতিকর। সবাইকে বিজয়ের শুভেচ্ছা।